top of page

বিঃ দ্রঃ- লেখাটি 'ব্যাপন' ম্যাগাজিনের নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে

BEYOND THE MICROSCOPE

UNCOVERING THE INHERENT TRUTH OF SCIENCE

“A Rare Bird in the lands and very much like a Black Swan.”

 

সময়টা তখন ৩ই মে,  ১৬৯৬ । উইল্যাম ডি ভ্লামিং নামে একজন ডাচ সি ক্যাপ্টেন অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলে যাত্রা শুরু করেছিলেন এক উদ্ধার অভিযানের জন্য ।  মূলত Ridderschap van Holland  নামে একটি জাহাজ দুই বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল । আর তাই ভ্লামিং সাহেব ও তার দল জাহাজটির খোঁজে টেক্সেল থেকে যাত্রা শুরু করেন । পথিমধ্যে অনেক জায়গায় খোঁজার পর অভিযানের ঠিক ২৫২ দিনের মাথায়  গিয়ে পৌছালেন সোয়ান নদীর তীরে । সোয়ান নদীতে পৌঁছে  ভ্লামিং সাহেব যা দেখলেন তা পুরো ইউরোপে মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিল । একবিংশ শতাব্দীতে যেটা যোগ করল নতুন এক দর্শন । “The Black Swan Theory”

–-----------

বিজ্ঞান মহলে বিজ্ঞানের  আবিষ্কার ও উপকারিতা নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ততটা আলোচনা  হয়না । বিজ্ঞানকে ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয় । মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ বিজ্ঞান কী? সেটাই জানেনা । সে আলোচনা না হয় অন্যদিন হবে । আজকে না হয় বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা যাক । বিজ্ঞান কী ধ্রুব সত্য? বিজ্ঞানের কাছে কী সব প্রশ্নের উত্তর আছে ? বিজ্ঞান  কী সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে? চলুন প্রশ্নগুলোর উত্তর একসাথে খোঁজা যাক । 

 

শুরুটা বিজ্ঞানের মৌলিক একটি শাখাকে দিয়ে শুরু করা যাক ।  বিজ্ঞানের রাণী বলা হয় গণিতকে । বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা এ গণিতের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। যেমনঃ পদার্থবিজ্ঞান গণিতের উপর, রসায়ন পদার্থবিজ্ঞানের উপর, জীববিজ্ঞান রসায়নের উপর নির্ভর করে । মোটকথা সবকিছুর মূলে রয়েছে গণিত। কিন্তু এখন প্রশ্ন জাগতে পারে গণিত তাহলে কীসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত? গণিত মূলত Axiom এর উপর প্রতিষ্ঠিত । Axiom হচ্ছে কতগুলো বিবৃতি যা আপনি প্রমাণ ছাড়া সত্য হিসেবে মেনে নিবেন বা বলা যায় এমন  কতগুলো  বিবৃতি যা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না । এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই আপনি হোঁচট খেয়েছেন । যেখানে বিজ্ঞানের সবকিছুর পেছনে প্রমাণ আছে বা লাগে , সেখানে বিজ্ঞানের একটি শাখা এমন এক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যা প্রমাণ করা যায় না? নিচের উদাহরণ দুটো লক্ষ্য করুন । দুইটা বিন্দুকে যোগ করলে আপনি সহজে একটি লাইন আঁকতে পারবেন, দুইটা সেট তখনই সমান হবে যখন তাদের উপাদান সমান হবে । এ উদাহরণগুলো আপনার কাছে নিতান্তই সাধারণ মনে হতে পারে , কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এদেরকে আপনি কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না । কেন? তার আগে চলুন একজন বিশেষ মানুষের মাথা নষ্ট করে দেয়া বিশেষ এক থিওরির দিকে নজর দেয়া যাক । বলা হয় The man who destroyed mathematics । নাম কার্ট গোডেল ।  তার বিখ্যাত  Incompleteness Theorem । বিংশ শতাব্দীতে যেটা মাথা ঘুরিয়ে  দিয়েছিল বড় বড় গণিতবিদদের । এই তত্ত্ব অনুসারে-

I. Axiom এর কোনো সিস্টেম স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় । অর্থাৎ একটি Formal সিস্টেমে এমন কিছু বিবৃতি থাকবে যা সিস্টেমের মধ্যে  প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু বিবৃতিগুলো সত্য ।

II. এমনকি একটি Formal সিস্টেম কখনোই প্রমাণ করতে পারবে না সে নিজেই সামঞ্জস্যপূর্ণ (consistent).

 

গোলমাল লাগছে, তাই না? চলুন  একটা সহজ উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বুঝা যাক । 

‘এই বাক্যটি মিথ্যা ।’ যদি আমরা ধরে নিই বাক্যটি সত্য তার মানে বাক্যটি মিথ্যা । আবার যদি ধরে নিই বাক্যটি মিথ্যা তার মানে বাক্যটি সত্য ।  বাক্যটি যদি সত্যই হয় তার মানে বাক্যটি মিথ্যা । আবার যদি বাক্যটি মিথ্যাই হয় তার মানে বাক্যটি সত্য । এভাবে Infinite Loop তৈরি করবে বাক্যটি । এটা একটা Paradox.  অর্থাৎ বাক্যটি সত্য নাকি মিথ্যা তা আপনি প্রমান করতে পারবেন না । একইরকমভাবে প্রাকৃতিক সংখ্যা ও তাদের Arithmatic (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি) এগুলো আপনি কখনো Formal সিস্টেমে প্রমাণ করতে পারবেন না । এ থিওরির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো একটি থিওরি আছে কম্পিউওটার সাইন্সে । নাম ‘Halting Problem’। সে এক ভিন্ন আলোচনা । তাছাড়াও হিলবার্ট হোটেল প্যারাডক্সের মতো সমস্যা মাথা ঘুরিয়ে দেয় সবার । 

 

–-----------

 

শুরুর গল্পটাতে ফিরে যাই । যে প্রবাদটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটি মূলত অসম্ভব কিছু বুঝাতে ১৭ শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা ব্যবহার করত । মূলত ১৬৯৭ সালের আগে মনে করা হত সকল রাজহাঁস সাদা রঙের হয় । তখন তারা এটিকেই সত্য হিসেবে মেনে নেয় । কিন্তু ১৬৯৭ সালে ভ্লামিংয়ের কালো রাজহাঁস আবিষ্কারের মাধ্যমে পূর্বের মেনে নেওয়া সত্যকে মূহূর্তেই বিদায় জানিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে রাজহাঁস সাদা কালো দুটো রঙেরই হয় । এটাই হচ্ছে মূলত অবজারভেশনাল লিমিটেশন । অর্থাৎ একটা তত্ত্বকে এতদিন ধরে সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া হলেও, নতুন পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা পুরোনো তত্ত্বকে নিমিষেই বিদায় জানিয়ে একটা নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় । এ বিষয়টা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝা যায় পারমাণুর মূল কণিকা তত্ত্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে । একসময় মনে করা হত ইলেকট্রন, প্রোটন ও ইলেকট্রন হচ্ছে পমাণুর মূল কণিকা । কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি, কোয়ার্ক ও নিউট্রন হচ্ছে পরমাণুর মূল কণিকা । বিজ্ঞানীরা এর আরো ছোট ভার্শন হিসেবে স্ট্রিং তত্ত্বের ধারণা প্রস্তাব করেছেন । এভাবে  নতুন পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা একটা সিদ্ধান্তকে আমূলে পালটে দেয় । তবে পর্যবেক্ষণই এখানে একমাত্র সীমাবদ্ধতা নয়, তার সাথে রয়েছে পর্যবেক্ষক কীভাবে সেটি পর্যবেক্ষণ করছেন । গোলমাল লাগছে তাই না? তাহলে নিচের দুটো ছবি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন । 

                ছবিঃ Rubin Vase                                               ছবিঃ The Duck Rabbit illusion

 

১ম ছবি দেখে আপনার মনে হতে পারে আপনি দুটি মানুষের মুখ দেখছেন । কিন্তু আপনি এবার এবার যদি চোখ ঝাপসা করে দেখেন তাহলে আপনি একটি ফুলদানির 2D ইমেজ দেখতে পাবেন । তারপর পাশের ছবিটি লক্ষ্য করুন, বাম পাশ থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটি হাঁস, কিন্তু ডান পাশ থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটি খরগোশ । এই অপটিক্যাল ইল্যুশনকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? 

ফুলদানি নাকি মানুষ? হাঁস নাকি খরগোশ? এটাই হচ্ছে পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণগত সীমাবদ্ধতা । পর্যবেক্ষক যা কিছু দেখেন তা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে কিংবা পর্যবেক্ষকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে অনেক কিছু । এছাড়াও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, পরিপার্শ্বিকতা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, প্রসঙ্গ নির্ভরতা, Cognitive biases এর মতো আরো অসংখ্য ফ্যাক্টর কাজ করে । 


 

–-----------


 

একসময় বিজ্ঞানীর মনে করতেন, কোনো কণার অবস্থান ও ভরবেগ নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে পারলে ভবিষ্যতে সিস্টেমের অবস্থা কী হবে সেটা আপনি বর্তমানে বসে নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন । তাদের এ চিন্তায় একেবারে পানি ঢেলে দেন বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ । তার বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে । তিনি দেখান একটা কণার অবস্থা ও ভরবেগ কখনো একই মূহূর্তে নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয় ।  যেহেতু একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো কণার অবস্থা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যেখানে অসম্ভব সেখানে ভবিষ্যত অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রশ্নই উঠে না । এতটুকু পর্যন্ত ভালোই ছিল । কিন্তু ঝামেলা আরো বাড়িয়ে দেয় Chaos Theory বা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব । Butterfly Effect কথা হয়তো শুনেছেন । এ Butterfly Effect, Chaos Theory-র বিখ্যাত একটা উদাহরণ । যেখানে বলা হয়, একটা সিস্টেমের প্রাথমিক অবস্থার ছোট্ট একটা পরিবর্তন ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে । একবার চিন্তা করুন তো, ফ্রেডরিক উহলার যদি সেদিন অ্যামোনিয়াম সায়ানেটকে তাপ না দিতেন তাহলে মনে হয় আজকের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের এত কষ্ট পেতে হতো না । কিংবা নিউটন যদি সেদিন আপেল গাছের নিচে না বসতেন?  একটা ছোট ইভেন্ট কীভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায় সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন । আর এজন্যই বিজ্ঞানীরা সম্ভাবনা দিতে পারেন, কিন্তু কখনো ভবিষ্যত নিয়ে নির্ভুল তথ্য দিতে পারে না ।  

 

–-----------

একটা ছোট্ট কথা । বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমরা সবচেয়ে যে ভুলটা করি সেটা হচ্ছে আমরা মনে করি বিজ্ঞানই সবকিছু করে । আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মূলত বিজ্ঞান নয় বরং বিজ্ঞানীদের হাজার হাজার বছরের প্রচেষ্টার ফলে বিজ্ঞান একটু একটু করে আজ এই অবস্থায় এসেছে । তবে মাঝে মধ্যে  বিজ্ঞানীরা এমন ব্যাখ্যা দিয়ে বসেন যেটা শুনলে আপনি রীতিমত তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন । বিজ্ঞানের সঙ্গে আপনি  বিজ্ঞানীদের  কোন যোগসূত্র  খুঁজে পাবেন না । এই যেমন গ্যালাক্সির ঘূর্ণন বক্ররেখা গ্রাফের মাধ্যমে জানা যায় গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরত্বের বৃদ্ধির সাথে সাথে নক্ষত্রগুলোর ঘূর্ণন গতি কীভাবে পরিবর্তিত হয় । যদি গ্যালাক্সি শুধুমাত্র দৃশ্যমান বস্তু দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে দৃশ্যমান বস্তুর দূরত্বের বৃদ্ধির সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হ্রাস পায়, আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে বক্ররেখাও ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে নিচে নামার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, গ্যালাক্সির  ঘূর্ণন বক্ররেখা দূরত্বের বৃদ্ধির সাথে সাথে হ্রাস পায় না । বরং বক্ররেখাটি সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে । অর্থাৎ নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব বৃদ্ধি পেলেও ঘূর্ণন গতি না কমে বরং বৃদ্ধি পায় । এখন প্রশ্ন জাগতে পারে দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে যেহেতু গতির এই পরিবর্তন ব্যখ্যা করা যাচ্ছে না, তাহলে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা এর পিছনে কাজ করছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত এক ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানীরা । বলা হয় এমন কিছু আছে যা ধরা যায় না, ছোয়া যায় না, এমনকি দেখাও যায় না, কিন্তু এই অদ্ভুত ঘটনার পিছনে এদের কারসাজি আছে । নাম দেয়া হল ডার্ক ম্যাটার । ধারণা করা হয় বিজ্ঞানীরা এখনো মহাবিশ্বের মাত্র ৪% জানতে পেরেছে । বাকি ৯৫-৯৬% কে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করছেন ডার্ক ম্যাটার (২৭%) এবং ডার্ক এনার্জি (৬৮%) হিসেবে । ডার্ক ম্যাটার গুলো বিজ্ঞানীরা এখনো অবজারভ করতে পারেনি, কিন্তু এগুলো যে কাজ করে সেটা আমরা আগেই দেখেছি । দার্শনিকরা দাবি করছেন ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে । শুধু ডার্ক ম্যাটার কিংবা ডার্ক এনার্জিই নয়, বরং বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন অবজারভেশন, নিত্যনতুন তত্ত্ব রীতিমতোই প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে । এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কতটুকুইবা জানি? কিংবা যা জানি তা কী আদৌ সঠিক? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভিন্ন এক সত্য? আমরা কি জানি না সেটাই আমরা জানিনা । এই মহাবিশ্ব আমাদের কল্পনার বাইরেও রহস্যময় ।

"The more we know about the universe the more we realise how much we don't know."

 

[1] Godel's incompleteness theorem: https://plato.stanford.edu/entries/goedel-incompleteness//

[2] Black Swan Theory: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Black_swan_theory 

[3] Galaxy rotation curve: https://en.wikipedia.org/wiki/Galaxy_rotation_curve

[4] Special Thanks: 

Edward Frenkel: https://youtu.be/u3GYrEOoKGk?si=IrIKm45jpFdigayn

& Alasdair Mackintosh

image.png
image.png
bottom of page